গ্যালিলিও গ্যালিলেই
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মতে আধুনিক যুগে প্রকৃতি বিজ্ঞানের এতো বিশাল অগ্রগতির পেছনে গ্যালিলিওর চেয়ে বেশি অবদান আর কেউ রাখতে পারেননি। তাঁকে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনকএবং এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের জনক হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটলীয় ধারণার অবসানে গ্যালিলিওর আবিষ্কারগুলোই সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রেখেছে।
ইতালি দেশের পিসা শহরে ১৫৬৪ সালে গ্যালিলিও জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ভিন্সেনজো গ্যালিলি গণিতজ্ঞ এবং সংগীতশিল্পী ছিলেন। ভিনসেঞ্জো 1520 সালে ইতালির ফ্লোরেন্স জন্ম নেন। তার মায়ের নাম গিউলিয়া আমানাতি। গ্যালিলিও ছিলেন বাবা মার সাত সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়।অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি ভাই বোন দের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবীও ছিলেন।
বেশ অল্প বয়স থেকে গ্যালিলিওর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সাধারণ শিক্ষার পর তিনি পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হন, কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন সেখানেই তার পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়। তার পরেও ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে গ্যালিলিও পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য একটি পদ পান এবং সেখানে গণিত পড়ানো শুরু করেন। এর পরপরই তিনি পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান এবং সেখানকার অনুষদে জ্যামিতি, বলবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। ওই সময়ের মধ্যেই তিনি বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন এবং বহু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেন।
গ্যালিলিও বিজ্ঞানের জগতে পরিমাণগত পরিমাপের পদ্ধতির গোড়াপত্তনে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর এই পরিমাপ ফলগুলো গাণিতিক সূক্ষ্মতার বিচারে উত্তীর্ণ হয়েছিল। একই সময় উইলিয়াম গিলবার্ট চুম্বকত্ব এবং বিদ্যুৎ নিয়ে বেশ কিছু পরিমাণগত অধ্যয়ন করেছিলেন। গ্যালিলিওর বাবা ভিনসেঞ্জো গ্যালিলি কিছু পরীক্ষা করেছিলেন যার মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এ পর্যন্ত জানা মতে প্রথম অরৈখিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। সুর সৃষ্টিকারী যন্ত্রের ওপর এই পরীক্ষা চালিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, একটি টানা তারের জন্য, পিচ টানের বর্গমূলের সমানুপাতিক।
# গ্যালিলিওর অবদান
দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার
চাঁদের কলঙ্কের কারণ আবিষ্কার
দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে জ্যোতিষ্কদের প্রথম পর্যবেক্ষণের ফল ‘সাইডরিয়াস নানসিয়াস’ বা ‘নক্ষত্র থেকে সংবাদবাহক’ গ্রন্থে লিপিবব্ধ হয় (প্রকাশকাল ১৬১০ খ্রিস্টাব্দ)। চাঁদের পৃষ্ঠের খাদ, ছোটো-বড়ো অনেক দাগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই গ্রন্থে আলোচিত হয়। ভূপৃষ্ঠের ন্যায় চাঁদের উপরিভাগে যে পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, নদী, গহ্বর, জলাশয় প্রভৃতির দ্বারা গঠিত গ্যালিলিও এইরূপ অভিমত ব্যক্ত করেন। দূরবীক্ষণ যন্ত্রে বড়ো বড়ো কাল দাগ দেখে তিনি তাদের সমুদ্র মনে করেছিলেন, পরে অবশ্য এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।
ছায়াপথ, বিষমতারা, নীহারিকা
খালি চোখে অদৃশ্য অসংখ্য নক্ষত্রের অস্তিত্ব দূরবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়ে। সে সময় খালি চোখে কৃত্তিকা তারামণ্ডলে মাত্র ৬টি নক্ষত্র দেখা যেত; কিন্তু গ্যালিলিও দূরবীক্ষণ যন্ত্রের দ্বারা ৩৬টি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন। সে সময়ের রহস্যময় ছায়াপথ আকাশগঙ্গা পর্যবেক্ষণ করে দেখান যে, তা আসলে অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি কিছু বিষমতারা এবং কয়েকটি নীহারিকাও আবিষ্কার করেছিলেন।
বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ আবিষ্কার
সৌর কলঙ্ক
১৬১০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম সূর্যে কতগুলো কালো দাগ পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের পূর্বে তিনি এ আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করেননি। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী টমাস হ্যারিয়ট, হল্যান্ডের জন ফ্যাব্রিসিয়াস ও জার্মানিতে শাইনার স্বাধীনভাবে সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষণ করেন, এবং তাদের আবিষ্কারের কথা গ্যালিলিওর আগেই প্রকাশিত হয়। সেই জন্য সৌরকলঙ্ক আবিষ্কারের কৃতিত্ব হ্যারিয়ট, ফ্যাব্রিসিয়াস, শাইনার ও গ্যালিলিও প্রত্যেকেরই আংশিকভাবে প্রাপ্য।
এইসব আবিষ্কারের ফলে কোপার্নিকাসের মতবাদ সত্যি বলে প্রমাণ হয় প্রতিষ্ঠিত হয় যে পৃথিবী সহ সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। আলোড়ন সৃষ্টিকারী এসব আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন গ্যালিলিও, কিন্তু এরপর প্রচন্ড বাধা আসে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গির্জা সংঘের তরফ থেকে। 1616 সালে গ্যালিলিওকে নির্দেশ দেয়া হয় কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রচার না করতে। এর ফলে কয়েক বছর নিরুপায় হয়ে বসে থাকতে হয় তাকে। 1623 সালে পোপের মৃত্যু হলে তার জায়গায় গ্যালিলিও এর এক ভক্ত অস্ত্র মারবান নতুন পোপ হিসেবে অভিষিক্ত হন। তিনি বিধিনিষেধ তুলে নেন। গ্যালিলিও পরে ছয় বছর কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রমাণ করতে "Dialogue Concerning The Two Chief World Systems" নামে এক গবেষণাধর্মী বই লেখার পেছনে সময় কাটান। 1632 সালে তিনি সেটি প্রকাশ করেন এবং গির্জার মুদ্রণ সংক্রান্ত অনুমতি নিয়েছিলেন এর জন্য। তারপরও বই প্রকাশ হওয়ার পর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে চার্চ এবং গ্যালিলিওকে 1616 সালে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার অপরাধে বিচারের জন্য ধরে নিয়ে আসা হয়। রোমে শেষ পর্যন্ত কোন কঠিন শাস্তি পেতে হয়নি তাকে। কিছুদিন নিজের বাড়িতে গৃহবন্দী হয়ে কাটাতে হয় তাকে। পরে আরো একবার শাস্তি পেতে হয় গ্যালিলিওকে। 70 বছরের বৃদ্ধ বিজ্ঞানী কে বলা হয় পৃথিবী সূর্যের চারদিকে নয় বরং সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এই কথাটা বলতে হবে তাকে কোর্টে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সে কথা গ্যালিলিও বলেননি কোনদিন, বরং কোর্টে দাঁড়িয়ে লোকের সামনে বলেন উল্টোটাই।
অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বন্দিদশাকালে তিনি গতির নিয়ামক সম্পর্কিত সূত্রাবলী শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন। নানা দুঃখ কষ্ট আর অভাব অনটনে এই মহান বিজ্ঞানী ও মহামানব জ্বরে ধুঁকে ধুঁকে গৃহবন্দিত্বের নয় বছরের মাথায় আরসেত্রিতে নিজের ভিলায় 1642 সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ৩২৬ বছর পর ১৯৬৮ সালে ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ গ্যালিলিওকে বিনা শর্তে ক্ষমা প্রদর্শন এবং তাঁর দণ্ডের আদেশ নাকচ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
কোন মন্তব্য নেই