স্যার আইজাক নিউটন
২০০৫ খ্রিস্টাব্দে রয়েল সোসাইটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি এ প্রশ্ন নিয়ে একটি ভোটাভুটির আয়োজন করে। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, এক্ষেত্রে নিউটন আইনস্টাইনের চেয়েও অধিক প্রভাবশালী।আধুনিক বিজ্ঞানের কথা চিন্তা করলে একসঙ্গে ভেসে ওঠে তিনটি চিত্র। প্রথমটি গ্যালিলিওর, শেষেরটি আইনস্টাইনের এবং এদের মধ্যমনি স্যার আইজাক নিউটন।
আইজ্যাক নিউটন জুনিয়র ১৬৪৩ সালের ৪ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের লিনকনশায়ারের এক ছোট্ট গ্রাম উলসথোর্পে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা পেশায় ছিলেন একজন কৃষক, যার নামও ছিল আইজ্যাক নিউটন, নিউটন জুনিয়রের জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন।নিউটনের জন্মের সময় তার শারীরিক ওজন এতটাই কম ছিলযে ডাক্তার তার আয়ু কিছু দিনের বেশি হবেনা বলেদিয়ে ছিলেন। তার মা হানাহ্ প্রায়ই বলতেন ছোট্টবেলার সেই নিউটনকে অনায়াসে একটি কোয়ার্ট মগের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া যেত।
তিন বছর বয়সে তার মা আরেকটি বিয়ে করেন এবং নতুন স্বামী রেভারেন্ড বার্নাবাউস স্মিথের সাথে বসবাস করতে থাকেন। এসময় নিউটন তার মায়ের সাথে ছিলেন না। নানী মার্জারি এইসকফের তত্ত্বাবধানে তার দিন কাটতে থাকে। নিউটন তার সৎ বাবাকে পছন্দ করতে পারেন নি। তার মা এই লোককে বিয়ে করেছে বলে মায়ের প্রতি তার কিছুটা ক্ষোভও ছিল। নিউটন তার ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত করা পাপ কাজগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। সেই তালিকা থেকে মায়ের প্রতি তার এই ক্ষোভের প্রমাণ পাওয়া যায়। তালিকায় লিখা ছিল : "আমার বাবা ও মা-কে এই বলে ভয় দেখানো যে আমি তাদের থাকবার ঘর জ্বালিয়ে দেবো"। নিউটনের মায়ের দ্বিতীয় বিবাহের ফলে তিন সন্তান জন্ম নেয়।
নিউটনের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় বাড়ির পাশের এক ক্ষুদ্রায়তন স্কুলে। ১২ বছর বয়সে তাকে গ্রান্থামের ব্যাকরণ স্কুলে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে তিনি এক ঔষধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতার বাড়িতে থাকতেন। এই স্কুলে নিউটন ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্ব্বি যা থেকে তার মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথমদিকে তার সাথে কেউ না পারলেও এক সময় আরেকটি ছেলে তার সাথে ভালো প্রতিযোগিতা করতে সমর্থ হয়েছিল। স্কুল জীবনের প্রথম থেকেই নিউটনের সবচেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র তৈরির প্রতি। সেই বয়সেই তিনি বায়ুকল, জল-ঘড়ি, ঘুড়ি এবং সান-ডায়াল তৈরি করেছিলেন। এছাড়া তার গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ ছিল একটি চার চাকার বাহন যা আরোহী নিজেই টেনে চালাতে পারতেন। ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে নিউটনের সৎ বাবা মারা যান। এরপর তার মা উল্সথর্পে ফিরে এসে তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল বাড়িতে ক্ষেত-খামারের কাজ শিখিয়ে ভবিষ্যতের বন্দোবস্ত করে দেওয়া। কিন্তু সত্বরই তিনি বুঝতে পারেন যে, খামারের কাজের দিকে নিউটনের কোনো ঝোঁক নেই। নিউটনের কাকা ছিলেন বার্টন কগলিসের রেক্টর। এই চাচার উপদেশ শুনেই পরিবার থেকে তাকে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়।
১৬৬১ সালে নিউটন ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে আইন বিষয়ক ডিগ্রী নিয়ে পড়া শুরু করেন। একই সাথে তিনি ধনী ছাত্রদের ব্যক্তিগত ভৃত্যের কাজ করেও টাকা আয় করতে শুরু করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে বিজ্ঞানীর হাত ধরে পদার্থবিদ্যার এত উন্নতি, সেই বিজ্ঞানীর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সময় পদার্থবিদ্যা বলতে আলাদা কোনো কিছু ছিলই না!
তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করতে করতে তিনি গণিত ও প্রাকৃতিক দর্শনশাস্ত্রে নিজ চেষ্টায় বেশ দক্ষ হয়ে ওঠেন। অ্যারিস্টটল এবং প্লেটোর প্রাচীন গ্রীক তত্ত্বের প্রতি প্রাথমিকভাবে কিছুটা আকর্ষণ অনুভব করলেও খুব শীঘ্রই তিনি তাদের তত্ত্বগুলোতে ভুল ধরতে পারেন। ফলে কলেজের শিক্ষা তার নিকট গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং তিনি রবার্ট বয়েল, গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং জোহান কেপলারদের মতো তার যুগের আধুনিক বিজ্ঞানীদের বই পড়তে শুরু করেন।ক্যামব্রিজে তিন বছর কাটানোর পরই তিনি একটি চার বছরের স্কলারশিপ লাভ করেন।
১৬৬৫ সালে নিউটন তার প্রথম বৃহৎ কোন গাণিতিক আবিষ্কার করেন। তিনি দ্বিপদ রাশির সার্বজনীন সমীকরণ আবিষ্কার করেন। সেই বছর তার বিএ ডিগ্রীও শেষ হয়। এবার তিনি পুরো মনোযোগ দিলেন চিন্তাভাবনায়। কিন্তু চলে আসলো বাধা। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ভয়াবহতম মহামারী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ। ফলে বন্ধ হয় কলেজ আর নিউটন চলে আসেন বাড়িতে।
উল্সথর্প ফিরে এসেও নিউটন থেমে থাকেননি। সেখানে মূলত রসায়ন এবং আলোকবিজ্ঞান বিষয়ের উপর বিভিন্ন পরীক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকেন এবং একইসাথে চলতে থাকে তার গাণিতিক অনূধ্যানের প্রকল্পসমূহ। নিউটন তার মহাকর্ষ তত্ত্ব আবিষ্কার বিষয়ক দিনপঞ্জির সূচনা চিহ্নিত করেছিলেন এই ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দকে, যে বছর তাকে ট্রিনিটি কলেজ ছেড়ে যেতে হয়েছিল।
# নিউটন এবং একটি আপেল
# নিউটনের গতিসূত্র
নিউটনের গতির তিনটি বিখ্যাত সূত্র হচ্ছে
১ম সূত্রঃ বল প্রয়োগ করা না হলে স্থির বস্তু চিরকাল স্থির এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল সরলপথে চলতে থাকবে।
২য় সূত্রঃ বলপ্রয়োগে কোনো বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তন এর উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে ক্রিয়া করে বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে হয়।
৩য় সূত্রঃ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
#ক্যালকুলাস
# আইজাক নিউটনের রচনাবলী:-
১৬৯৬ সালে নিউটন রাজকীয় টাকশালের ওয়ার্ডেনের দায়িত্ব পান। ১৭০০ সালে তিনি টাকশালটির ‘মাস্টার’ পদে নিয়োগ পান। সেই বছরই তিনি ক্যামব্রিজ একেবারের জন্য ছেড়ে লন্ডন চলে যান। সোজা কথায় তার বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। ১৭০৩ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দু’বছর পর ১৭০৫ সালে তিনি ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং ‘আইজ্যাক নিউটন’ থেকে হয়ে যান ‘স্যার আইজ্যাক নিউটন’।
১৭২৫ খ্রিস্টাব্দের পর নিউটনের স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি ঘটে। এর ফলে একজন ডেপুটি মিন্টে তার কাজ মওকুফ করার ব্যবস্থা করে দেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি শেষবারের মত রয়েল সোসাইটির সভাপতি হিসেবে কার্য পরিচালনা করেন। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই তিনি এই সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ই মার্চ ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি-তে সমাধিস্থ করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই