Header Ads

মিশরীয় পিরামিড

 



পিরামিড পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্যের একটি। প্রাচীন মিশর শাসন করতেন ফিরাউনরা (প্রাচীন মিশরীয় শাসক বা রাজাদের ফিরাউন (Pharaoh) বলা হতো)। তাদেরকে কবর বা সমাধী দেয়ার জন্যই পিরামিড নির্মান করা হতো।মিসরে ছোটবড় ৭৫টি পিরামিড আছে। 

মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত মৃত নগরী আল গিজা। এখানে দেখা পাওয়া যায় তিনটি বড় বড় পিরামিডের। এগুলো হল যথাক্রমে ফারাও খুফু, তাঁর ছেলে ফারাও খেফ্রে এবং খেফ্রের ছেলে মেনকাউরে এর পিরামিড। এঁরা সবাই ছিলেন মিশরের চতুর্থ রাজবংশের রাজা। তবে এই তিনটি তো বটেই মিশরের সবগুলো পিরামিডের মধ্যে ফারাও খুফুর পিরামিডটি হল সবচেয়ে উঁচু এবং আকারে সবচেয়ে বড়। একারণে ফারাও খুফুর পিরামিডটি গিজার গ্রেট পিরামিড নামেও বহুল পরিচিত। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ষড়বিংশ শতক থেকে, চতুদর্শ শতক পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ চার হাজার বছর এটিই ছিল মানব সৃষ্ট সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা। তাই খুব সহজে অনুমেয় প্রযুক্তি ও প্রাচুর্যে প্রাচীনযুগে মিশরীয় সভ্যতা অন্য সভ্যতাগুলোর চেয়ে কত বেশি অগ্রসর ছিল।

গিজার গ্রেট পিরামিডটি তৈরির সময়কাল ২৫৬০ থেকে ২৫৪০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ। প্রকৃত উচ্চতা ৪৮১ ফুট হলেও বর্তমান উচ্চতা ৪৫৫ ফুট। পিরামিডটির ভূমি বর্গাকৃতির এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ উভয় দিকেই ৭৫৬ ফুট। পাথরের বড় বড় চাঁই দিয়ে বানানো এই স্থাপনাটি আসলে কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল সেটা আজও গবেষকদের কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আরও অবাক করা বিষয়টি হল এর নির্মাণের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল ২৩ লক্ষ বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের। একেকটি পাথরের চাঁইয়ের ভর ছিল গড়ে কমপক্ষে ২ টন থেকে ১৫ টন। এমনকি কিছু কিছু চাঁইয়ের ভর ৫০ টনেরও বেশি ছিল। চাঁইগুলোর বেশির ভাগই ছিল লাইম স্টোনের। গুণে মানে অনন্য এই লাইমস্টোনগুলো আনা হত তুরা অঞ্চল থেকে। নীল নদের পূর্ব তীর থেকে জলপথে নিয়ে আসা হত এগুলো।

গিজার গ্রেট পিরামিডটি নির্মাণ করতে ঠিক কতজন শ্রমিক লেগেছিল সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে জনসংখ্যা ও খাদ্য সরবরাহ পর্যালোচনা এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রকে একত্রে করে মোটামুটি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান গেছে। ধারণা করা হয় প্রায় ৪০০০-৬০০০ পাথর খোদাইয়ে দক্ষ রাজমস্ত্রী একটানা প্রায়  বিশ বছর সময় ধরে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিল। তবে নীলনদের দান প্রাচীন মিশর বছরে তিনমাস ডুবে থাকত পানির নিচে। অনুমান করা হয় এই সময়গুলোতে লক্ষাধিক কৃষকও তাদের সাথে যোগ দিত

প্রাচীনকালে মিশরীয়রা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতো, মৃত্যুর পরও তাদের আত্মা বেঁচে থাকে। কাজেই পরবর্তী জীবনে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, জীবনটাকে যাতে উপভোগ করা যায়, সে চিন্তায় মিশরীয়রা অস্থির থাকতো। ব্যক্তির গুরুত্বের ওপর নির্ভর করে গুরুত্ব আরোপ করা হতো এ ব্যাপারে। ব্যক্তি যতো গুরুত্বপূর্ণ হতো এ কাজে গুরুত্ব ততো বেশি বেড়ে যেতো। পরবর্তী জীবনের আরাম-আয়েশের জন্য স্বভাবতই ফারাওদের ব্যাপারেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। ক্ষমতায় আসা নতুন ফারাওয়ের প্রথম কাজ সম্পন্ন করা। প্রত্যেকেই চাইতেন বিশাল আয়তনের হোক তার সমাধিক্ষেত্র। অনেকেই মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যেত। এসব সমাধিক্ষেত্র আসলে মৃতের আত্মার ঘর। মিশরীয়রা মনে করত, লাশ বা মৃতদেহ টিকে থাকার ওপরই নির্ভর করে আত্মার বেঁচে থাকা বা ফিরে আসা। এ কারণেই মৃতদেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মমি করতো তারা। আত্মার বেঁচে থাকার জন্য চাই প্রয়োজনীয় নানা জিনিস। তাই নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিশেষ করে খাবার-দাবার মৃতদেহের সাথে দিয়ে দিতো তারা। সমাধিস্তম্ভ প্রধানের দায়িত্ব ছিলো দস্যুদের হাত থেকে মৃতদেহ আর তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষা করার। কিন্তু কবরে সমাধিত ব্যক্তিটি কত বিপুল পরিমাণ বিত্ত আর ক্ষমতাবান ছিল তা জাহিরের উদ্দেশ্যেও নির্মাণ করা হতো পিরামিড। তাই ফারাওদের মৃতদেহের সাথে কবরস্থ করা হতো বিপুল ধন-সম্পদ। সমাজের বিত্তশালীদের কবরেও মূল্যবানসামগ্রী দেয়া হতো। এমনকি, নিন্মশ্রেণীর মানুষদের কবরেও সামান্য পরিমাণ হলেও কিছু খাবার রেখে দেয়া হতো।

পিরামিড নিয়ে  ভ্রান্ত ধারণা

 পিরামিডের মতো অতিকায় স্থাপত্য কীভাবে সম্ভব হলো, কীভাবে তার বিরাট বিরাট পাথরগুলোকে দূর থেকে বয়ে আনা হলো- এসব রহস্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে মানুষ অনেক তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। এর মাঝে সবচাইতে জনপ্রিয়টি হলো ভিনগ্রহী প্রাণী তত্ত্ব। গিজার পিরামিডের নির্মাণশৈলী এখনকার মানুষকে স্তম্ভিত করে দিতে পারে, তবে তা ঐ সময়ের গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদদের অজানা ছিল না। তাদের প্রকৌশলীদের দক্ষতা আর দৃঢ় মনোবলই ছিল পিরামিড তৈরির মূল রহস্য। হিস্টোরি চ্যানেলের 'প্রাচীন ভিনগ্রহী প্রাণীরা'(Ancient Aliens) এর মতো অনুষ্ঠানগুলো জনমনে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। খোদাইকৃত ছবিগুলোতে ফুলদানি ও বিভিন্ন আকৃতির জিনিসকে ভিনগ্রহের প্রাণী বলার চেষ্টাও কম হয়নি। পিরামিড নিয়ে এখন বেশ কিছু তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেছে, যার একটি হলো- পিরামিড পর্যন্ত খাল কেটে নৌকায় পাথর বয়ে আনা হতো, যা বিশ্বাসযোগ্য। দেখতে অতিমানবীয় পরিশ্রমের হলেও একে ভিনগ্রহের প্রাণীদের অবদান বলে দেওয়াটা প্রাচীন মিশরের মানুষের মেধা ও দক্ষতার অপমান।

 অনেকেই বিশ্বাস করেন, পিরামিড খুঁজে পাওয়ার পর মিশর সম্পর্কে মানুষের সবকিছু জানা হয়ে গেছে, যা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। আজও প্রতিনিয়ত সেখানে কিছু না কিছু আবিষ্কার হয়েই চলেছে। গিজার পিরামিড থেকে পাওয়া গেছে সূর্য প্রতীক সম্বলিত নৌকা। ধারণা করা হচ্ছে, এই নৌকা রাখার কারণ ফারাওয়ের সাথে সূর্য দেবতা 'রা'য়ের যোগাযোগের পথ করে দেওয়া। অন্ধকারের দেবতা আপেপের সাথে রায়ের লড়াইয়ে যেন সঙ্গ দিতে পারেন ফারাও, তাই এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাসমতে, প্রতিরাতে সৌর নৌকা দিয়ে রা যুদ্ধ করতে যান আপেপের সাথে, ভোরবেলায় ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে।


অনেক মিশরীয় সমাধিসৌধে হায়ারোগ্লিফিকের ছড়াছড়ি দেখা গেলেও পিরামিডগুলো সেই তুলনায় সাদামাটা। গিজার পিরামিড আবিষ্কারের সময়ে মনে করা হয়েছিল, এর ভেতরটা হয়ত ফাঁকা। তারপর আবিষ্কৃত হয় গুপ্ত কুঠুরি। এর পেছনে লুকিয়ে ছিল অনেক হায়ারোগ্লিফ। ৪০০০ বছর আগে পিরামিডগুলোর সবটুকু চুনাপাথরের রঙের ছিল না। পিরামিডের ভেতরের স্তম্ভের রঙ ছিল লাল বা সাদা। রঙ হোক বা লেখা, পিরামিডের সাজসজ্জা সাধারণ মানুষের কল্পনার চেয়ে অনেক কম। পিরামিডকে খ্যাতি দিয়েছে তার অলঙ্কার নয়, বরং প্রকৌশল। তবে ফারাওদের সমাধিগুলো তাদের উপযুক্ত সম্মানের করেই তৈরী হতো। পিরামিডের বহিরাবরণ তৈরি ছিল মসৃণ, পালিশ করা সাদা চুনাপাথর দিয়ে। পাথরগুলোকে ততক্ষণ পালিশ করা হতো, যতক্ষণ না সূর্যের আলোয় চকচক করে। এমনকি রাতের আলোয় মরুভূমিতে বহুদূর থেকে দেখা যেত পিরামিডকে। একদম উপরের পাথরটাকে সোনা বা কোনো চকচকে ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হতো। শত শত বছর আগের এই চকচকে রঙ মুছে গেছে সিংহভাগ দেয়ালের।



















কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.