সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু:
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে যে কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের কথা জানা যায়, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম (যিনি ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের কাছে জে. সি. বোস নামে পরিচিত)। তিনি তাঁর সময়ে বাঙালী বিজ্ঞানীদের মধ্যে পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞান চর্চায় ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বর্তমান বাংলাদেশ) অঞ্চলের মুন্সিগঞ্জ জন্মগ্রহণ করেন। বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে তার পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল। তার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।এর পূর্বে তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্র এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।
তৎকালীন ভারতবর্ষে ইংরেজি বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে সম্মানের চোখে দেখা হত কিন্তু ভগবান চন্দ্র বসু তার ছেলেকে একজন প্রকৃত দেশ প্রেমিক হিসাবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন । এইজন্য তিনি তার ছেলেকে গ্রামের একটি বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করেন ।কারণ তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার পূর্বে আমাদের বাংলা ভাষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা হওয়া উচিত ।
জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তার আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজি হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তার পুত্র একজন বিদ্বান হোন।
বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তার ভগ্নিপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকূল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তার শিক্ষক ছিলেন।
১৮৮৫ সালে তিনি লেখাপড়া শেষে ভারতে ফিরে আসেন। সেই সময়ে লর্ড রিপনের অনুরোধে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। চাকরিতে ঢুকেই তিনি কলেজের অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র সাম্প্রদায়িকতা অনুভব করেন। কারণ ব্রিটিশ অধ্যাপকেরা যে বেতন পেত সেই তুলনায় তাঁর বেতন ছিলো বেশ নগণ্য। এই ব্যবস্থা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তাই প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি প্রায় তিন বছর কোনো বেতন গ্রহণ করেন নি, কিন্তু অধ্যাপকের কাজ থেকেও বিচ্যুত হননি। এই তিন বছর তিনি শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে গিয়েছেন বেতন ছাড়াই। পরে পাব্লিক ইন্সট্রাকশন ও প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের চেষ্টায় তাঁকে স্থায়ীভাবে অধ্যাপক হিসেবে নিয়ে নেয়া হয় এবং তাঁর তিন বছরের পুরো বেতন দিয়ে দেয়া হয়।
সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের আরো কিছু স্বল্পতা ছিলো। সেখানে ছিলো না কোনো ভালো মানের ল্যাবরেটরি, না ছিলো মৌলিক গবেষণা করার সুযোগ। কিন্তু বোস কলেজের সহায়তার আশায় বসে থাকেন নি। তিনি নিজেই গবেষণার জন্য নিজের টাকায় ফান্ড তৈরী করে নেন। ১৯৯৪ সালে তিনি হার্জিয়ান তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কার করেন মিলিমিটার তরঙ্গের ।প্রফেসর হিসেবেও তাঁর কীর্তি কম নয়। তাঁর স্নেহধন্য ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সত্যেন্দ্র নাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, প্রশান্ত চন্দ্র, মহলানবিস, শিশির কুমার মিত্র, দেবেন্দ্র মোহন বসু সহ আরো অনেক।
১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে অবলার বিয়ে হয়। অবলা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা। বিয়ের আগে অবলা বসু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন মেয়েদের পড়ানো নিষেধ ছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজে যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থিক কষ্টের মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যে আবার তিনি তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না। এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তার পরিবারকে পথে বসতে হয়। এর মধ্য থেকে অবলা ও জগদীশ অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন। সব ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কিছুদিন মাত্র বসুর পিতা-মাতা জীবিত ছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে তিনিই পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চা (এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্স) শুরু করেছিলেন। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লিখেছেন। তার গবেষণা উদ্ভিদবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা করেন।বিজ্ঞানী মার্কনি রেডিও আবিষ্কারের আগেই বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বিনা তারে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তথ্য-সংকেত বিনিময়ে সক্ষম হয়েছিলেন এবং প্রদর্শনও করেছিলেন।নিরহংকারী এই মহাত্মা গোটাকয়েক যন্ত্রের আবিষ্কার করলেও পেটেন্টের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন না। এমনকি রেডিও সিগনাল শনাক্তকরণে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার বিষয়ে তার করা গবেষণাপত্র তিনি উন্মুক্ত করে দেন যেন অন্যান্য বিজ্ঞানীগণ এটি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।১৯০৯ সালে মার্কনিকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হলো। আর বাঙালি বিজ্ঞানী বেতার তরঙ্গের সৃষ্টির আবিষ্কারক হিসেবে অজ্ঞাত থেকে গেলেন।
পদার্থবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় তিনি বিভিন্ন সমস্যা সামধানের চেষ্টা করেছিলেন। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল, বিশেষ করে জীব পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও পুরাতত্ত্ব-এগুলো নিয়েও তার কাজ আছে।
তিনি সব সময় জীব ও জড়ের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান খুঁজতেন। বিজ্ঞানের ও জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন শাখায় জগদীশ কাজ করেছিলেন শুধু সত্য জানার উদ্দেশ্যে।তিনি বিশ্বকে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে।তিনি তাঁর এই কথাকে স্পষ্টরূপে প্রমাণ করার জন্য এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যার সাহায্যে উদ্ভিদ দেহের স্পন্দন মাপা যায় । পরবর্তী সময়ে এই যন্ত্রটি “ক্রেসকোগ্রাফ” নামে পরিচিতি লাভ করে ।গবেষণাকে প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি গাছকে ব্রোমাইড নামক বিষাক্ত গ্যাসযুক্ত একটি পাত্রে রেখে দেন । এরপর তিনি লক্ষ্য করেন সেই গাছটির পালস সাধারণ জীবজন্তুর মতই অস্থির হচ্ছে ।
কখনো গাছটির স্পন্দন কমে যাচ্ছে আবার কখনও খুব বেড়ে যাচ্ছে | এইভাবেই কিছুদিন চলার পর অবশেষে একসময় ধীরে ধীরে গাছটি মারাও যাচ্ছে ।এই পরীক্ষার পর তিনি স্থির সিদ্ধান্ত নেন যে প্রাণীদের মত উদ্ভিদ দেহেও প্রাণ আছে।
তিনি তাঁর এই তথ্যকে প্রমাণ করার জন্য বেশ কিছু বিজ্ঞানীকে আমন্ত্রণ করেন এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে একটি গাছে বিষ ঢুকিয়ে দেন। এরপর তিনি তাদের বলেন যে ধীরে ধীরে এই গাছটির পালস কমে যাবে এবং একসময় মারা যাবে । কিন্তু কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরেও তা হয় না । গাছটি তখনও আগের মতই সতেজ থাকে ।তাঁর এই কাণ্ডকারখানা দেখে সেখানে উপস্থিত সমস্ত বিজ্ঞানী তাঁকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করেন।
জগদীশচন্দ্র বসু অবশ্য তখনও নিজের গবেষণার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন । তিনি তাদেরকে বলেন “আমার গবেষণা ভুল হতে পারে না” এই বলে তিনি সেই বিষ ভর্তি ইঞ্জেকশনটি নিজের ওপর প্রয়োগ করতে যান।তখন বিজ্ঞানীদের ভিড় থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে বলেন যে তিনি বিষ ভর্তি ইনজেকশন পাল্টে তার জায়গায় একটি জল ভর্তি ইঞ্জেকশন রেখে দিয়েছিলেন ।
১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে এই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তার আজীবন সঞ্চিত ১৭ লক্ষ টাকার মধ্যে ১৩ লক্ষ টাকা 'বসু বিজ্ঞান মন্দির'কে দান করেন।
কোন মন্তব্য নেই