পুরো নাম উইলিয়াম হেনরী গেটস বা বিল গেটস । তাকে আমারা বিল গেটস নামে চিনি। একাধারে ১৩ বছর যাবৎ তিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি ছিলেন।
বিল গেটসের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৮ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের সিয়াটল এলাকায়।পিতা উইলিয়াম হেনরি। পেশায় নামকরা উকিল। পিতার নাম অনুসারে বিল এর নাম রাখা হয় উইলিয়াম হেনরী গেটস। মা মেরি ম্যাক্সওয়েল গেটস।ছোট বিলের মাথায় প্রায়ই প্রশ্ন আসতো কিভাবে কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলো কাজ করে ? এই কৌতূহল ও আগ্রহ থেকেই এক সময় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর প্রেমে পড়ে যান। তার এই প্রোগ্রামিং এর প্রতি আগ্রহ দেখে স্কুল তাকে তার গণিত ক্লাস থেকে অব্যাহতি দেয় এবং প্রোগ্রামিং অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দেয়। কম্পিউটার সেকশনে বসেই গেটস তার প্রথম প্রোগ্রাম তৈরী করেন যার নাম রাখেন “Tic-Tac-Toe”। যে প্রোগ্রামটি মূলত কম্পিউটারের সাথে গেম খেলার জন্য ব্যবহার করে বিল সবাইকে চমকে দেন। এই প্রসঙ্গে বিলের একটা মজার কাহিনী বলি, কিশোর বিল গেটস কিন্তু একেবারেই শান্তশিষ্ট ছিলেন না। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর পছন্দের সব মেয়েকে এক ক্লাসে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। কিশোর বিল গেটসকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কম্পিউটার ব্যবহার করে একটি ক্লাস শিডিউল তৈরি করে দিতে বলেছিল। এই সুযোগ কাজে লাগান তিনি। তাঁর পছন্দের সব মেয়েকে দিয়ে নিজের ক্লাস ভরান।
১৯৭৩ সালে বিল লেকসাইড স্কুল থেকে তার গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। মজার ব্যাপার হলো, সেইবার তিনি SAT পরীক্ষায় ১৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় ১৫৯০ পেয়েছিলেন।
বাবা ও মায়ের অনেক ইচ্ছা ছেলে বড় হয়ে উকিল হবে, কিন্তু গেটস এর এই ব্যাপারে কোনো মাথাব্যাথা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পরেও কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না যে তিনি কিভাবে নিজের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনি অনেক চিন্তা ভাবনা করে হাভার্ড এর সবচেয়ে জটিল গণিত কোর্স বেছে নিলেন। সেখানেও বিলের ফলাফল ছিল অবিস্মরণীয়। মজার ব্যাপার হলো হার্ভার্ডে পড়ার সময় যেসব কোর্সের জন্য নিবন্ধন করেছিলেন, তার একটিতেও হাজিরা দেননি। এর পরিবর্তে তাঁর ভালো লাগত যেসব ক্লাস, সেখানে বসে যেতেন। তবে তাঁর মুখস্থবিদ্যা ছিল দুর্দান্ত। ফলে চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাঁকে আটকায় কে? ফলে ক্লাস না করেও সব সময় এ গ্রেড পাওয়া ছাত্র ছিলেন বিল। তবে মন ছিল না এগুলোর মধ্যে। স্কুল জীবনে যেমন রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছিল কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে, আর এখন যেন বিল নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। শেষে একদিন গেটস তার বন্ধু পল অ্যালেন এর সাথে যোগাযোগ করেন এবং বন্ধুর আমন্ত্রণেই সাড়া দিয়ে অ্যালেন ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্ম কালে এসে ভর্তি হলেন হাভার্ডে। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তার সাথে পরিচয় হয় বর্তমান মাইক্রোসফট এর সহকারী পরিচালক স্টিভ বালমার এর সাথে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালের দ্বিতীয় বছরে বিল কিছু অসংজ্ঞায়িত প্রোগ্রামিং সমস্যা “Pancake sorting” নামে একটি সিরিজ সমাধান তৈরী করেন, যেটি উপস্থাপন করেন তার প্রফেসর হ্যারি লুয়িস। বিগত ৩০ বছরের মধ্যে বিল এর সমাধানটিকেই সবচাইতে দ্রুততম সিরিজ সমাধান বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়। পরবর্তীতে তার এই সমাধান নিয়েই হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ক্রিস্টোস পাপাদিমিত্রিও তার গবেষণা চালান এবং তা পেপারব্যাক হিসেবে প্রকাশ করেন
তিনি তার স্কুলের বন্ধু পলের সাথে পার্টনারশীপে একটি অফিস খুলেন। নিউ মেক্সিকোর ‘’Albuquerque’ নামে এক এলাকায় প্রথম অফিস খুলেন। ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বরে মেক্সিকোর বানিজ্য সচিবের অনুমতিক্রমে MITS এর আওতায় একটি প্রতিষ্ঠান খুলেন। এটই ছিল Microsoft এর প্রথম অফিস।
পরে ১৯৭৭ সালে MITS থেকে Microsoft সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠান সফটওয়ার ডেভেলপমেন্ট এর উপর কাজ করতে থাকে। বিল ভাবলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানকে তার নিজ দেশে নিয়ে যেতে হবে। তিনি নিউ মেক্সিকো থেকে Microsoft কে ওয়াশিংটন শহরের Bellevue শহরে নিয়ে আসেন। এখানে এসে কোম্পানীর জন্য লোন খুজতে শুরু করলেন। নতুন কোম্পানী বলে কেউই লোন দিতে রাজি নয়। অনেক চেষ্টা করে কাছের এক ব্যাঙ্ক থেকে লোন পান তিনি।
১৯৮০ সালে IBM একক ব্যবহারের জন্য একটি কম্পিউটার তৈরির সিধান্ত নেয়। Acron ছদ্মনামে একটি গোপন প্রজেক্ট শুরু করে। এই কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম তৈরির জন্য Microsoft কে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপরে Pc-dos নামক একটি অপারেটিং সিস্টেম IBM কে দেয়া হয়। IBM এটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে একটা বিষয় হল যে PC-dos অপারেটিং সিস্টেমটি কিন্তু সম্পূর্ণভাবে Microsoft দ্বারা তৈরি না। বিল গেইটস ওয়াশিংটন শহরের সিয়াটল শহরের ছোট্ট একটি হার্ডওয়ার দোকান থেকে QD-DOS(Quick and dirty dos) নামে একটি অপারেটিং সিস্টেম কিনে নেন। এটিকেই IBM এর মাইক্রোপ্রোসেসর অনুযায়ী পরিবর্তন করে Pc-dos করা হয়।
১৯৮৫ সালে বিল গেটসের স্বপ্ন পূরনের বছর। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজেদের তৈরি একটা অপারেটিং সিস্টেম তিনি বাজারে ছাড়বেন। ২০ নভেম্বর Microsoft প্রকাশ করলো তাঁদের প্রথম অপারেটিং সিস্টেম Windows 1.0.
১৯৯২ সালের দিকে তিনি IBM এর আওতা থেকে মুক্ত হলেন। অর্থাৎ তিনি সম্পুর্ন আলাদাভাবে Microsoft Windows এর এডিশনগুলো ছাড়তে লাগলেন। Microsoft এর বাজার সমৃদ্ধ্য হতে লাগল। আস্তে আস্তে Microsoft বাজারে বেশ ভাল ভাবে আসন নিইয়ে নিল।
ইউভার্সিটিতে পড়ার সময় বিল গেটস তার ইউনিভার্সিটির এক টিচারকে তার নিজের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন তার যখন ৩০ বছর হবে তখন তিনি মিলিয়নার হবেন কিন্তু তিনি বিলিয়নার হন বয়স ৩১ হওয়ার আগেই। মাইক্রোসফট উইন্ডোজ এর নানা ভার্সন বাজারে আসার পর বিল এর প্রচার প্রসারের পাশাপাশি অর্থ সম্পদ ও বেড়েছে অনেক দ্রুত। ১৯৮৭ সালে Forbes পত্রিকার তার ৩২ তম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০০ বিলিওনিয়ারের তালিকায় উঠে আসে বিল গেটসের নাম। তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয় বিশ্বের সবচাইতে কমবয়সী আত্মপ্রচেষ্টায় হয়ে ওঠা বিলিওনিয়ার নামে। তখন তার সম্পদের পরিমান ছিল ১.২৫ বিলিওন মার্কিন ডলার। তার এই স্বীকৃতির কয়েকদিন পূর্বেই তার ধন সম্পদের তালিকায় যোগ হয়েছিল আরো ৯০০ মিলিওন মার্কিন ডলার এবং তা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে।
এত অর্থ সম্পদের মালিক বিল গেটসের জীবন খুব সাধাসাধি ভাবে কাটাতে ভালবাসেন। ওয়াশিংটনের মেডিনার লেকে পর্বত মুখি ছিমছাম বাড়ি তাঁর। এই বাড়ির নাম ‘The Gates Home’। ৬৬০০০ বর্গফুটের এই বাড়িতে ৬০ ফুট গভীর সুইমিংপুল। সুইমিনপুলের সাথে ওয়াটার মিউজিক সিস্টেম। আরো আছে ২৫০০ ফুটের ব্যামাগার এবং ১০০০ ফুটের ডাইনিং স্পেস।
অনেক পত্রিকায় তিনি গবেষনামূলক লেখা লিখেছেন। ১৯৯৯ সালে মাইক্রোসফটের Nathan Myhrvold এবং সাংবাদিক Peter Rinearson এর সাথে যৌথভাবে লেখা বই The road ahed. ১৯৯৯ সালে প্রযুক্তিগত বই Business @ the speed of thought প্রকাশিত হয়।
তাকে নিয়ে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি হয়ে ছে। উল্লেখযোগ্য হল “Waiting for superman” এবং BBC এর “The virtual Revolution”
কোন মন্তব্য নেই